গানটা সবাই শুনেছেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই মনে রাখেন না, ভুলে যান, সময়মতো হঠাৎই মনে পড়ে যায়, তখন ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়। চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়, আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়, কাহারও সমান নাহি যায়। সে এক সময় ছিল, কংগ্রেসের জমানা, মাস্তানদের দখলে মহল্লা, সেই কংগ্রেস আজ কোথায়? এই বাংলাতে তারা কই? তারও পরে বাম জমানা, ভাড়াটে থেকে প্রেম, স্কুলের ফাংশন থেকে তেলেভাজার দোকান সর্বত্র শেষ কথাটি বলতেন এলসিএস নামের এক অসম্ভব শক্তিশালী প্রাণী। আজ? কোথায় সেই দাপট? এখন তাঁরা বিনয়ী, মানুষের কাছে মানুষের পাশে। কারণ সময় থাকতে মনেই রাখেননি ওই কথাগুলো যে চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। আবার ধরুন তৃণমূল জমানাতেও এরকম হেক্কড়বাজদের দেখেছি আমরা, মুচকি মুচকি হাসতেন আর গুড়-বাতাসার কথা বলতেন, সাম্রাজ্য আছে কিন্তু তিনি কোথায়? কেষ্ট মোড়লের ওজন কমেছে, তাঁকে ছাড়াই হয়ে গেল গণতন্ত্রের মহোৎসব। কোথায় শেখ শাহজাহান? ভেড়ি সাম্রাজ্যের দখলদার? হাঁক দিয়েছেন, ধানি জমি এসেছে নোনাজল ঢুকিয়ে বাগদা চাষ হয়েছে, কোটি কোটি টাকার? আজ? ওই ধর্ষণ ইত্যাদি টিকবে না কিন্তু জমি হাঙর শাহজাহান অ্যান্ড কোম্পানি আজ খরচের খাতায়। হিটলার মুছে গেল, তারও আগেই কবেই ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে চেঙ্গিজ খান আর তৈমুর লং, কিন্তু বহু মানুষের মনেই থাকে না ওই গান, চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। গতকাল আমাদের দিলু ঘোষকে দেখে সেই কথাটাই মনে পড়ল, তাই এটাই বিষয় আজকে, ইট ছুড়লে পাটকেলের জন্য তৈরি থাকুন।
দিলু ঘোষ গত নির্বাচনের সময়ে বলেছিলেন তেমন হলে বুদ্ধিজীবীদেরও রগড়ে দেবেন, কী অনাবিল আনন্দে সে কথা বলেছিলেন শুধু নয়, তা নিয়ে পরবর্তীতে একগাল হেসে বলেছেন যা বলেছি বেশ করেছি। তো কথায় কথায় রগড়ে দেব, থাপ্পড় মেরে চোয়াল ভেঙে দেব, মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেব এসব ওনার সাধারণ লব্জ, কাল সেই সব অবিশ্রান্ত ইট ছোড়ার বদলে একটা পাটকেল যেই পড়েছে ওনার গাড়িতে অমনি পুলিশ, মিডিয়া, এই দেখুন আমাকে মারছে, ও মা আমি আর খেলব না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: Aajke | রাজভবনের সিসিটিভি ফুটেজ, আনন্দ বোসের বোকামি
সভ্য সমাজে এগুলো চলে না, সভ্য সমাজে ইটের বদলে পাটকেল মারাও শোভনীয় নয়, চোখের বদলে চোখ নিতে থাকলে একদিন গোটা দুনিয়াটাতে থাকবে কেবল অন্ধ মানুষজন বলেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু ওই যে, ক’জন আর ওই সহনশীলতা দেখাতে পারে? ধরুন এই সেদিনে সন্দেশখালিতে এক তৃণমূল কর্মীকে কিছু মহিলা আক্ষরিক অর্থে গণধোলাই দিলেন, ছেলেটি কি শ্লীলতাহানি করেছিল? ছেলেটি কি লম্পট, চোর বা তার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক কোনও অভিযোগ আছে? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কিন্তু কেবল স্টিং অপারেশনের ভিডিওগুলোকে ভাইরাল করা, তার জন্য তাকে ঘিরে ধরে মারা হল। সভ্য সুসভ্য বলেই চিহ্নিত প্রাজ্ঞ সাংবাদিকের কী উল্লাস, সন্দেশ বড় বিপজ্জনক গোছের ভিডিও বানিয়ে ফেললেন, বটমলাইন হল দেখ কেমন লাগে? অন্য আরও অনেকেই এই একই পথে। কিন্তু এই ইটের বদলে যখন ছুটে আসবে পাটকেল তখন এই নব আনন্দেই জ্ঞান বিতরণ করতে পারবেন তো? যখন শেখ শাহজাহানের ভেড়ির অফিসে আগুন লাগানো হচ্ছিল, দেখেছিলাম, সে ছিল এক গণরোষ, তা কি উচিত? উচিত কি উচিত নয়ের থেকেও জরুরি হল মানুষের পবিত্র ক্ষোভ, তারা এক দীর্ঘ চাপা অত্যাচারের প্রতিবাদ করছিলেন, সেটাও ছিল ওই ইটের বদলে পাটকেল দিয়ে জবাব। সমাজ ক্রমশ এক ললেসনেস-এর দিকে ছুটে চলেছে, তার কারণ আইন তাকে বিচার বা সুবিচার দেয় না। কাজেই চটজলদি সমাধান হল ইটের বদলে পাটকেল, কিন্তু আবার সেই বৃদ্ধের কথাটাই বলি, এর বদলা ওটা, ওটার বদলা সেটা, সেটার বদলা ওটা চলতে থাকলে গোটা সমাজটার চেহারা কেমন হবে বলুন তো? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, দিলীপ ঘোষ এতদিন ঠ্যাং ভেঙে দেব, মেরে চোয়াল ভেঙে দেব বলে চিৎকার করতেন, গতকাল তাঁর গাড়ির কাচ ভাঙার পরে কিন্তু তিনি নিজেই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন, এতদিন ইট ছুড়তেন আজ পাটকেল খেয়ে তার জ্ঞান ফিরেছে, রাজনীতিতে এই ইটের বদলে পাটকেল মারার সংস্কৃতি কি বন্ধ হওয়া উচিত নয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
রাজনীতি হোক আলোচনার ক্ষেত্র, যাঁরা মানুষের ভালো, দেশের ভালো করার জন্য রাজনীতিতে আসেন তাঁদের মুখের ভাষা সংযত হোক। হিংসাকে পিছনে রেখে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব, আজ পর্যন্ত ইতিহাস সেই কথাই তো বলেছে, যুদ্ধ তো শেষ হয় পাল্টা যুদ্ধ দিয়ে নয়, যুদ্ধ শেষ হয়, সমান্তরাল আলোচনার মাধ্যমে। এটা মাথায় রাখলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। না হলে ওই রগড়ে দেব, চারদিক থেকে ঘিরে লাইফ হেল করে দেব, চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজাব গোত্রের রাজনীতিই চলবে।